সেক্সবয়
তসলিমা নাসরিন
[ফেসবুক টুইটার কিংবা স্কাইপের মত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো আমাদের হাজার বছরের যাপিত জীবনকে কিভাবে বড় একটি ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছে এবং ধীরে ধীরে আমাদের মূল্যবোধ, সামাজিকতা, পারপস্পরিক সম্পর্ক দ্রুত পরিবর্তিত করে দিচ্ছে তার উজ্জল প্রমাণ তসলিমা নাসরিনের এই গল্পটি।]
চৈতালি অপেক্ষা করছে সেক্সবয়ের জন্য। সন্ধেও নামবে,
সেক্সবয়ও নামবে কলকাতায়। অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে দক্ষিণ কলকাতার এই গলিতে ঢুকবে
বিমানবন্দর থেকে আসা সেক্সবয়ের ট্যাক্সি। বোম্বে থেকে আসছে সে। চৈতালির ফ্ল্যাটেই
উঠবে। দু’জনের গত ছ’মাস যাবৎ প্রায় সব হয়েছে, শুধু সামনাসামনি দেখাটাই হয়নি। ফেসবুকে প্রথম কথা
হয়, মূলত সেক্সের কথা। চৈতালিকে আকৃষ্ট করেছিল সেক্সবয় নামটি। প্রোফাইলের ছবিটি
উলঙ্গ পুরুষের। এর সঙ্গে সেক্স ছাড়া আর কী বিষয়ে কথা বলা যায়! চৈতালি সেক্স নিয়ে
কথা বলতেই সেক্সবয়কে বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। নিজের যৌনসম্পর্কহীন জীবন বড়
দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। শহরে এত যুবকের ভিড়, আর চৈতালির মতো সুন্দরী বিদুষী মেয়ের জন্য
কোনো প্রেমিক জোটে না! সত্যিই জোটে না। যে লোকটির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার, সেটিও
হয়েছিল বাবার ঠিক করে দেওয়া পাত্র। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে সুব্রতকে ডিভোর্স
করেছে চৈতালি। এরপর একেবারেই যে কারও সঙ্গে কিছূই ঘটেনি তা নয়। দশ বছরের ছোট এক
কলিগ অশোকের সঙ্গে প্রায় একমাস মতো একটা সম্পর্ক ছিল চৈতালির। কিন্তু অশোকের বিয়ের
পর ওই সম্পর্কটা ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয় সে। চৈতালি চায়নি ঘরে তরুণী স্ত্রী রেখে তার
সঙ্গে গোপনে শুতে আসুক অশোক। একটি ইংরেজি দৈনিকে চাকরি করে চৈতালি। অনেকদিনের
চাকরি। অনেক দায়িত্ব। কিন্তু কোনো অফিসের কোনো বোঝা চৈতালি বাড়ি বয়ে আনতে চায় না।
বাড়িতে থাকতে চায় সে ভাবনাহীন। সামান্য কিছুক্ষণ সময় নিজের জন্য রাখতেই তো হয়,
কিছুক্ষণই তো সময়! ওদিকে মেয়ে পড়ছে দিল্লিতে। ওর খোঁজখবরও করতে হয়। আজকাল মোবাইল
যুগে খোঁজ খবরের ব্যাপারগুলো জলের মতো সোজা। অফিস তো অফিস, চৈতালি না থাকলেও অফিস
থাকবে। মেয়ের জীবনও মেয়ের জীবন। চৈতালি মরে গেলেও মেয়ে দিব্যি মানিয়ে নেবে।
চৈতালির বাবা ও মা মারা গেছেন। চৈতালিই ছিল একমাত্র সন্তান। মা-বাবার কথা তার এখন
খুব মনেও পড়ে না। অফিস থেকে ফিরে চৈতালি আগে একটা বই নিয়ে বসতো পড়তে। এখন ফেসবুক
নিয়ে বসে। ফেসবুক যে কী ভয়ঙ্কর এক নেশার মতো! আসলে, ফেসবুক নয়, সেক্সবয় প্রতিদিন
যে বলছে চৈতালির সঙ্গে বিছানায় সে কী কী করবে, কী করে চৈতালির সারা শরীরে চুমু
খাবে, কী করে ঠোঁটে, বুকে আদর করবে, কী করে চৈতালির স্বাদ নেবে, আর তাকে ঘন ঘন
শীর্ষসুখ দেবে… সেসব পড়ার নেশা। এই নেশাটা তাকে প্রচুর অস্থিরতা
থেকে মুক্তি দিয়েছে। এখন সে রাস্তাঘাটে বা অফিসের যুবকগুলোর দিকে আগের মতো চাই চাই
চোখে তাকায় না। সেক্সবয় চৈতালির দৈনন্দিন জীবনকে অনেক পূর্ণ এবং তৃপ্ত করেছে। মনে
মনে সে কৃতজ্ঞ সেক্সবয়ের কাছে। ফেসবুকে সম্পর্কটা এখন আটকে নেই। দু’মাস যাবৎ প্রায় প্রতিদিন কথা হচ্ছে ফোনে, আর শেষ
কয়েকদিন স্কাইপেতে দু’জনের সেক্সও ঘটেছে। সেক্সবয়ের আসল নাম বিজয়, মারাঠী,
আর্কিটেক্ট, বয়স পঁয়ত্রিশ। এর চেয়ে চমৎকার জুটি আর কী হতে পারে! বোম্বে থেকে
কলকাতায় উড়ে এসে চৈতালির সঙ্গে সত্যিকার সেক্সের প্রস্তাবটি চৈতালিই দিয়েছিল
বিজয়কে। শুধু তাই নয়, বোম্বে কলকাতা আসা যাওয়ার টিকিটও ইমেইল করেছিল। টিকিট পেয়ে ‘লেটস ফাক হোল উইক’ বলে লাফিয়ে উঠেছিল বিজয়। বিজয়কে ছুঁয়ে দেখতে চায় চৈতালি। সত্যিকার মৈথুন
চাই, হস্তমৈথুন শরীর আর নিতে চায় না।
সাতদিনের ছুটি নিয়েছে চৈতালি, আজ বিকেলেই অশোক
জিজ্ঞেস করেছে, ‘হঠাৎ এতদিনের ছুটি কেন? কোথাও যাচ্ছো?’ চৈতালি হেসে বলেছে, ‘ক্লাউড নাইনে’ যাওয়ার ফ্লাইট বুক করেছি। যাবি? ‘বিয়েটা না করলে ঠিক ঠিকই যেতাম। চৈতালির ঠোঁটে একচিলতে
হাসি। অশোকের জন্য সেই আকর্ষণ আর নেই চৈতালির, বিজয় এসে অশোকের জায়গা, চৈতালি জানে
না, কবেই দখল করে নিয়েছে। অশোকের বিয়ের পর বিজয়ের মতো একজন পুরুষেরই দরকার ছিল তার
জীবনে, এরকম বানের জলের মতো কেউ, পুরানো সব স্মৃতি ভাসিয়ে নেবে, øিগ্ধ শীতল নতুনতা
ছড়িয়ে তাকে আরও উজ্জ্বল করবে, যেন সে জন্ম নিল এইমাত্র, অতীত বলে কিছু ছিল না কখনও
তার। অশোক অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছে, ‘কী কারও প্রেমে পড়েছ নাকি, দেখতে আরও উজ্জ্বল হয়েছ।’ মিষ্টি হেসে চৈতালি বলেছে, ‘এই, মুনা কেমন আছ? চলছে তো সব ঠিকঠাক? বলে, অশোকের
উত্তরের জন্য না অপেক্ষা করেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে চৈতালি। প্রতিদিন যখন বেরোয়
তার চেয়ে খানিক আগেই বেরিয়েছে। শরীর জুড়ে বিজয় তার। সকাল থেকেই শরীরে বান ডাকছে।
বাড়িতে এসে গান গাইতে গাইতে øান করেছে। এত সময় নিয়ে
চৈতালি øান করে না খুব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ সেজেছে। পারফিউম মেখেছে।
শোবার ঘরটা সাজিয়েছে। নতুন চাদর বিছিয়েছে বিছানায়। দুটো শুধু বালিশ ছিল, নতুন দুটো
বালিশ যোগ করেছে। বড় ফ্ল্যাট চৈতালির। তিনটে শোবার ঘর। একটায় চৈতালি থাকে। আরেকটা
অতিথির জন্য। আরেকটায় থাকে শকুন্তলা। শকুন্তলা পুরানো কাজের লোক। শকুন্তলা জিজ্ঞেস
করেছে, ‘আজ অশোক বাবু আসছে নাকি চৈতি, এত সাজগোজ করছ যে?’ শুনে বিরক্ত কণ্ঠে চৈতালি বলেছে, ‘তুমি যে দিদি কী আবোলতাবোল বকো, অশোক বউ নিয়ে সুখের
সংসার করছে, ও আসবে কেন?’
‘তাহলে, নতুন ভাগ্যবানটা কে শুনি?’
চৈতালি হেসে বলেছে, ‘এলেই দেখতে পাবে।’
শকুন্তলা প্রচুর রান্না করেছে আজ। বিজয় আর চৈতালি
ক্যান্ডেল-লাইট ডিনার করবে। তারপর শোবার ঘরে চলে যাবে, দরজা বন্ধ করে দেবে ঘরের।
জানালার পর্দাটা সরিয়ে দেওয়া। বিছানা থেকেই জানালার ওপারের চাঁদটা দেখতে পাবে।
জ্যোৎস্নায় ঘর ভরে যাবে, আর ওই আলোয় তারা শরীরে শরীর ডুবিয়ে স্নান করবে সারা রাত।
শোবার ঘরটায় চৈতালি জুঁইয়ের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে রাখে। নিজের গায়েও সুগন্ধী। বাড়িটায় যেন
ফুলের উৎসব হচ্ছে। কণিকার রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি চালিয়ে দেয়। ‘হৃদয়বাসনা পূর্ণ হলো’ গানটি বাজতে থাকে। চৈতালি গাইতে থাকে কণিকার সঙ্গে। কখনই খুব ভালো গাইতে
জানে না চৈতালি। কিন্তু গান ভালোবাসতে ভালো জানে। চৈতালি একটা নীল রঙের শাড়ি
পরেছে। ইচ্ছে করেই খুব বড় গলার ব্লাউজ পরেছে। স্তনজোড়া উঁকি দিচ্ছে, দিক। লরিয়েলের
কালো রঙ চৈতালির চুলে। সামান্যই পেকেছে যদিও, চৈতালি মুছে ফেলেছে সাদার চিহ্ন।
চল্লিশের টান টান শরীর, কিন্তু চুলে পাকন, ঠিক মেলে না। এমনিতে কালো সাদায় তার
কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সেক্সবয়ের সঙ্গে সাতটা দিন ঘনিষ্ঠ সময় কাটাবে, বয়সের
চিহ্নটিহ্ন এসে না হয় এই সাতটা দিন না জ্বালাক।
বিজয় ফোন করেছে দমদমে নেমেই। রেড লেবেলের একটা বোতল
আর দুটো গ্লাস এনে শোবার ঘরের খাটের পাশের টেবিলে রাখে চৈতালি। এরকম অ্যাডভেঞ্চার
আগে কখনও করেনি সে। একটা অচেনা মানুষের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হলো, তার সঙ্গে
যৌনসম্পর্কে যাওয়ার জন্যই সব আয়োজন দু’জন করছে, কোনো প্রেম হলো না, কেউ কারও জন্য ভালোবাসি শব্দটা উচ্চারণ করলো
না, যৌনতা ছাড়া জগতের অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হলো না! দু’জনের কিন্তু কারওরই মনে হচ্ছে না খুব বিচ্ছিরি কোনো
কাজ তারা করছে। দু’জনই প্রাপ্তবয়স্ক। দু’জনই একা থাকে। কোনো স্বামী বা কোনো স্ত্রীকে ঠকিয়ে কিছু করছে না তারা। শরীর
চাইলে শরীর তারা তবে কেন মেলাবে না!
সকাল থেকেই শরীরে বান ডাকছে। চৈতালীর মনে হতে থাকে সে
নিতান্তই ষোলো বছর বয়সী এক কিশোরী। না হয় সে ষোলো বছর বয়সীই। ষোলো বছর যখন বয়স,
তখন সে কঠিন কঠিন বই পড়ে। কাটিয়েছে, চল্লিশ বা পঞ্চাশ বয়সীরা যা করে। সেই ষোলোটা
ফেরত পাওয়ার যদি সুযোগ হয়, তবে ফেরত সে নেবে না কেন! কাউকে তো দিব্যি দেয়নি যে
ফেলে আসা কোনো বয়স সে কোনোদিন ফেরত নেবে না।
চৈতালির কাছে বিজয় সম্ভবত আস্ত একটি পুরুষাঙ্গ ছাড়া
আর কিছু নয়। সে বলে-কয়েই সাতদিন শুতে আসছে চৈতালির সঙ্গে। শুধু শরীরের আকর্ষণকে
ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে একটা সম্পর্ক। চৈতালি ভাবে, সবসময় যে আগে মন, পরে শরীর হতে
হবে তারইবা কী মানে, শরীর আগে, মন পরে হওয়াটাই বরং বেশি যৌক্তিক। দরজা খোলার সঙ্গে
সঙ্গেই নিশ্চয়ই বিজয় ওকে জড়িয়ে ধরে গভীর করে চুমু খাবে। তারপর সোজা শোবার ঘরে।
দৃশ্যগুলো কল্পনা করে চৈতালি। আবেগে চোখ বোজে। শরীরে নিভৃতে গর্জন করে সুখের
স্রোত। শকুন্তলাকে বলে রেখেছে, ঘরের দরজা বন্ধ করে যেন সে শুয়ে থাকে, দরকার হলে
ডাকবে। কেবল খাবার সময় শকুন্তলার ডাক পড়ে। শকুন্তলা জানে নিয়মগুলো। অশোকের সময়
এরকমই ঘটতো। চৈতালির ডিভোর্সের পর শকুন্তলা বলেছে অনেকবার, ‘এবার একটা বিয়ে করো চৈতি’। বিয়ে করব না করব না বলে কয়েক বছর পার করেছে। তারপর
অশোকের সঙ্গে যখন প্রেম করছে চৈতালী, শকুন্তলা বলেছে, ‘তাহলে একজন বন্ধুকেই পার্মান্যান্ট করে নাও। কাউকে যে
ইচ্ছে করলেই কিছু করে নেওয়া যায় না, তা শকুন্তলাকে শত বলেও বোঝাতে পারে না চৈতালি।
শকুন্তলা চৈতালির জন্মের সময় থেকে এই বাড়িতে আছে। বিয়ে করেনি। অথচ চৈতালির বিয়ে না
করা আর স্থায়ী সঙ্গী না নেওয়া নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। নিজের চেয়ে মনিবের
পরিবারকে আপন করে দেখলে বুঝি এই হয়।
২.
বিজয় এল। ফোটো দেখে বা স্কাইপেতে দেখে যেমন অনুমান
করেছিল, তার চেয়ে অন্যরকম, যতটুকু লম্বা ভেবেছিল, তার চেয়ে বরং খানিকটা বেশি, যতটা
মোটা লাগছিল, তার চেয়েও স্লিম, যতটা সুদর্শন ভেবেছিল, তার চেয়েও বেশি সুদর্শন
বিজয়। দু’জন হাই বিজয়, হাই চৈতালি বলে হাত মেলাল। শোবার ঘরে
নেওয়ার বদলে চৈতালি বসার ঘরে নিয়ে এল বিজয়কে। দু’সোফায় মুখোমুখি বসল দু’জন।
একটুখানি দৃষ্টি বিনিময়। একটুখানি হাসি দু’জনের ঠোঁটে। চৈতালি বসে আছে বিজয় উঠে এসে ঠিক স্কাইপেতে যেমন বলত, ‘ইউ লুক সো হট হানি। কাম অন, লেটস হ্যাব সেক্স’ বলে কিনা। বিজয় নিজেই কাপড় খুলে ফেলত, ক্যামেরাকে
নামিয়ে দিত উরুসন্ধির দিকে, আর চৈতালিও খুলত বুকের কাপড়। দুটো যৌনকাতর নারী-পুরুষ
আজ মুখোমুখি বসে আছে। দু’টো শরীরের বাসনা আজ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। তবে দু’জনের কথোপকথনে যৌনতার তিলমাত্র কিছু নেই।
- একটু জল খাবো।
- আই অ্যাম সরি। জল আগেই দেওয়া উচিত ছিল। চা বা কফি
কিছু খাবে?
- না। আমি খাই না ওসব।
- তবে কি, হুইস্কি খাবে?
- হুইস্কি তো আমি খাই-ই না।
- ও
ক’টার সময়
রাতের খাবার খাও?
- ঠিক নেই। বেশ সুন্দর সাজানো ফ্ল্যাট। এত বই কার? সব
তোমার?
- হ্যাঁ আমার।
বিজয় উঠে বইয়ের তাকগুলোর দিকে যায়, মগ্ন হয়ে বই দেখতে
থাকে। অনেকক্ষণ কেটে যায় এভাবে। চৈতালি জল এনে দিলে বই দেখতে দেখতেই জল খায়।
- ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি কি কিছু বই বের করতে পারি
এখান থেকে?
- হ্যাঁ নিশ্চয়ই, গো এহেড।
বিজয় তিনটে বই নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। সোফায়
এসে বলল, তুমিও দেখছি রডি ডয়েলের বই পছন্দ কর। দ্য ডেড রিপাবলিক পড়েছ?
চৈতালি হেসে বলল, ওর শুধু তিনটে পড়েছি, প্যাডি
ক্লার্ক হাহাহা, এ স্টার কল্ড হেনরি আর দ্য গাটস।
- তোমার অসাধারণ কালেকশন।
- ক্লাসিকস বেশ কিছু আছে।
- ক্লাসিকসের কথা বাদ দাও। ওগুলো ছোটবেলায় পড়েছি।
ইদানীং বিল ব্রাইসন থাকলে আমার আর কিচ্ছু চাই না।
- আছে বিল ব্রাইসন বেশ কটা।
চোখেমুখে খুশি উপচে ওঠে বিজয়ের।
- তুমি বিল ব্রাইসনও পছন্দ কর? বাহ! কোনগুলো আছে বল
না। শেষটা আমার এখনও পড়া হয়নি।
- আমার সবচেয়ে পছন্দ এ সর্ট হিস্টরি অব নিয়ারলি
এভরিথিং।
- ও বইটার তুলনা হয় না।
- আমার কাছে আছে আই অ্যাম এ স্ট্রেঞ্জার হেয়ার
মাইসেল্ফ, অ্যট হোম, নাইদার হেয়ার নর দেয়ার…
- ওয়ান সামারটা তো এখনও বেরোয়নি বোধহয়।
- এই অক্টোবরে বেরোবে।
বিজয়ের মধ্যে একটা কিশোর বাস করে। দেখে ভালো লাগে
চৈতালির। চৈতালির মতোই সে উজ্জ্বল উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে সময় সময়। বইয়ের গল্পে মেতে ওঠে
বিজয়। যেন দু’জনে কোনো বুক ক্লাবের মেম্বার। বইয়ের পছন্দে এত মিল
আর কারও সঙ্গে নেই চৈতালির। তারপর কথায় কথায় বেড়ানোর কথা উঠল, ভারতের কোথায় কোথায়
কে গেছে। তাতেও মিল, দু’জনে বর্ণনা করতে থাকে দু’জনের পছন্দের জায়গাগুলোয় নিজেদের অভিজ্ঞতা। এক সময়
খাবারের প্রসঙ্গ ওঠে, ওতেও মিল। দু’জনই বাঙালি খাবার পছন্দ করে।
দশটা বেজে যায় গল্প করতে করতে। জল ছাড়া কেউ আর কিছু
পান করে না। ফলের রসও, বিজয় বলেছে, খাবে না। শকুন্তলাকে ডাকে চৈতালি। শকুন্তলা
টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেয়। না, মোমবাতি জ্বালানোর প্রয়োজন মনে করে না চৈতালি। খেতে
খেতে বিজয় বলে, ‘বাহ, বেশ কম তেলে কম মশলায় রান্না তো। আমার মা’র রান্নার মতো। ‘শকুন্তলা ভালো রাঁধে। শকুন্তলার বেশ প্রশংসা করল। বিজয়। চৈতালির থালায় নিজে
খাবার বেড়ে দিল। খাওয়া শেষ হলে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের থালা নিজেই ধুয়ে রেখে এল।
পরিপূর্ণ ভদ্রলোক। দেখে বেশ ভালো লাগে চৈতালির। কলকাতায় আজ অবধি এমন ভদ্রলোক সে
দেখেনি। খেয়ে ওঠার পর বিজয় বলল চৈতালিকে কাল ডিনারে নিয়ে যাবে সে, কলকাতার সবচেয়ে
ভালো বাঙালি খাবারের রেস্টুরেন্টে। শকুন্তলা জিজ্ঞেস করল, বিজয়ের মা কী কী রাঁধেন,
শুধু মারাঠী রান্না, নাকি বাঙালি রান্নাও? বিজয় অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থেকে বলে যে তার
মা মারা গেছেন এক বছর হলো। সড়ক দুর্ঘটনায়। বিজয় মায়ের সঙ্গেই থাকত। বিয়ে করে আলাদা
হয়ে গেছে দাদা। গাড়িটা সেদিন চালাচ্ছিল বিজয় নিজে। দাদার বাড়ি থেকে ডিনার খেয়ে
ফিরছিল বান্দ্রায় নিজের বাড়িতে। মদ্যপান করেছিল। বোমার মতো একটা ট্রাক ছুটে আসছিল
তার গাড়ির দিকে, দেখতে পায়নি। ট্রাক এসে ধাক্কা মারল, আর গাড়িটা গড়াতে গড়াতে খাদে
পড়ে গেল। ওখানেই মারা যায় মা। বিজয় চোট পেয়েছিল, তবে হাসপাতালে দুদিন থাকার পর তা সেরে
যায়। সেদিনের পর থেকে বিজয় আর মদ ছোঁয়নি। মায়ের কথায় মায়ের কথা আসে। শকুন্তলাও
মায়ের গল্পে যোগ দেয়। চৈতালি অনেকদিন ভুলে ছিল নিজের মাকে। আজ যেন মা তার সামনে
এসে বসেছে। স্মৃতির ঝাঁপি সকলেই খুলে বসে। সকলের চোখ ভিজে ওঠে। বিজয় তার মায়ের
প্রসঙ্গ না তুললে সম্ভবত এভাবেই চৈতালি ভুলে থাকত মাকে। বারোটা বেজে যায়। বিজয়
বলে, ‘আমি কোথায় ঘুমোব?’
চৈতালি কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর হেসে বলে শকুন্তলাকে, ‘তুমি দিদিসোনা গেস্টরুমের বিছানাটা ঠিক করে দাও।
চাদরটা চেঞ্জ করে দিও। আমার ঘরে এক্সট্রা বালিশ আছে, নিয়ে যেও।’
বিজয় আগে কখনও কলকাতায় আসেনি। চৈতালি বলে, কাল তোমাকে
ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে নিয়ে যাব। আর মার্বেল প্যালেসে। তোমার ভালো লাগবে।
বিজয় ‘অ্যাট হোম’ বইটি হাতে নিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, ‘এই বইটা কি রাতে পড়ার জন্য নিতে পারি? এটা আমার পড়া
হয়নি।’
৩.
যে কটা দিন ছিল বিজয়, কিশোর-কিশোরীর মতো চৈতালি আর
বিজয় কলকাতার রাস্তায় টই টই করে ঘূরেছে, রাস্তার কিনারের তেলেভাজা থেকে ভজহরি
মান্নার খাবার কিছু বাদ দেয়নি। হাতেটানা রিকশায় চড়েছে গঙ্গায় নৌকো চড়েছে, যেদিকে
খুশি সেদিকে চলে গেছে। চৈতালি ভুলে গেছে তার চাকরিবাকরি, তার কন্যা, তার অতীত
ভবিষ্যৎ। যেন সে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে, সবার নাগালের বাইরে, কোনো অচেনা আকাশে
উড়েছে। সত্যিকার ‘ক্লাইড নাইন’ বোধহয় একেই বলে। শকুন্তলাকে বিজয় উপহার দিয়েছে দু’টো চমৎকার শাড়ি, এত ভালো শাড়ি নাকি শকুন্তলা ইহজন্মে
পরেনি। চৈতালির জন্য গনেশ পাইনের একটা পেইন্টিং। প্রথম একজন মানুষের সঙ্গে দেখা
হলো, যার সঙ্গে ভাবনা চিন্তার প্রায় সম্পূর্ণই মিল পেল চৈতালি। জীবনের অনেক কথা
বলেছে সে বিজয়কে। স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের কথা, মেয়ের মেয়ের কথা, অশোকের কথা,
একরাশ দুঃখসুখের কথা। সব মন দিয়ে শুনেছে বিজয়। বিজয়ও বলেছে, তবে বলার চেয়ে বিজয়
শুনতেই বেশি পছন্দ করেছে। মাত্র ক’টা দিনে কী অসম্ভব আপন হয়ে উঠেছে বিজয়। যেন বিজয় তার ছোটবেলার কোনো বন্ধু।
যেন বিজয়ের সঙ্গে শৈশব-কৈশোর জুড়ে চৈতালি এক্কাদোক্কা খেলেছে, মার্বেল লাটিম
খেলেছে, পুকুরে মাছ ধরেছে। মাঝে মধ্যে অতীতের কোনো ঘটনা বলতে গিয়ে চৈতালির চোখে জল
এসেছে। আলতো করে বুকে টেনে তাকে শান্ত করেছে বিজয়। বিজয়ের ওটুকু স্পর্শই পেয়েছে
চৈতালি গোটা সাতদিনে। চুমু খেতে একবার দু’বার চেয়েছিল, কিন্তু বারণ করেছে নিজেকে। ভেবেছে, বিজয় বন্ধুত্ব ছাড়া আর
কিছু ভাবছে না।
বিজয় চলে যায়, চৈতালিকে দিয়ে যায় চৈতালির শ্রেষ্ঠ
সময়। চৈতালির আর জিজ্ঞেস করা হয়নি, ফেসবুকে সেক্সবয় নামের আড়ালে বিজয়ের চরিত্র কেন
তার ফেসবুকের বাইরের বিজয়ের চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত? জিজ্ঞেস করেনি, অনুমান করে
নিয়েছে, মায়ের মৃত্যুর কারণে যে ভীষণ গ্লানি আর শোকে ভুগছে বিজয়, তা থেকে মুক্তি
পেতেই আশ্রয় নিয়েছে ফেসবুকে, ভিন্ন চরিত্রে। চৈতালি কেন আশ্রয় নিয়েছে ফেসবুকে! তার
তো কোনো গ্লানি নেই, শোক নেই! কিছু হয়ত চৈতালির ভেতরেও আছে, চৈতালি জানে না। বিজয়
জানে কি? জিজ্ঞেস করা হয়নি বিজয় জানে কি না। এ ক’দিনে একবারও চৈতালির শরীরে বান ডাকেনি। শুধু মনেই ঝরেছে ঝড়বৃষ্টি। চৈতালির
ফেসবুকের চরিত্রটা কি চৈতালির সত্যিকারের চরিত্র নয়! চৈতালি ভাবে, কোন বিজয়
সত্যিকারের বিজয়! যে বিজয়ের সঙ্গে নেটে দেখা হয়, নাকি যে রক্তমাংসের বিজয়ের সঙ্গে
কলকাতায় দেখা হলো! রক্তমাংসের বিজয়ই তো ফেসবুকের সেক্সবয়, যার সঙ্গে রাতে রাতে তার
শরীরের উৎসব হয়। কত যে রহস্য একজন মানুষের ভেতর। সম্ভবত কয়েকজন মানুষ একসঙ্গে বাস
করে একজন মানুষের মধ্যে। একজন আরেকজনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।
বিজয়কে এয়ারপোর্টে সি অফ করে যখন বাড়ি ফিরছিল, উদাস
তাকিয়েছিল গাড়ির জানালায়, তখন এসএমএস আসে।
বিজয় লিখেছে, আই লাভ ইউ।
বুক কাঁপে চৈতালির। তীব্র ভালো লাগা মন থেকে শরীরে ছড়িয়ে
যায়।
চৈতালি লিখল, মি টু।
ঘরে ফিরে দেখে সেই যে কণিকার সিডিটা বাজছিল, সেটা
বেজেই চলেছে, কণিকার কণ্ঠে তখন, ‘চিরসখা হে
ছেড়ো না মোরে…’
সঙ্গে সঙ্গে গায় চৈতালি, ‘চিরসখা হে ছেড়ো না মোরে…’।
তসলিমা নাসরিনের দারুণ একটি Tech Story "সেক্সবয়" >>>>> Download Now
ReplyDelete>>>>> Download Full
তসলিমা নাসরিনের দারুণ একটি Tech Story "সেক্সবয়" >>>>> Download LINK
>>>>> Download Now
তসলিমা নাসরিনের দারুণ একটি Tech Story "সেক্সবয়" >>>>> Download Full
>>>>> Download LINK